সারাদেশ

কুড়িগ্রামে চরাঞ্চলে কৃষিতেই বদলে দিয়েছে মানুষের ভাগ্য

  মমিনুল ইসলাম বাবু ,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি 29 January 2021 , 5:22:34 প্রিন্ট সংস্করণ

শুধু নিজের পরিবার নয়, চর সারোডোবের প্রায় প্রতিটি পরিবারকেই অভাব-অনটনের দুর্দশাগ্রস্ত সময় পার করছেন স্থানীয় কৃষক মো. মজিবর রহমান(৫০)। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নে ধরলা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত চরটিতে সে সময় চাষাবাদ হতো সনাতনী পদ্ধতিতে। ফসল হতো খুবই কম। মাসের পর মাস কাউনের ভাত খেয়ে থেকেছে এ অঞ্চলের মানুষ। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে চরাঞ্চলের মানুুষের ভাগ্য। মজিবর রহমানের মতো চরাঞ্চলের কৃষকদের কাছে অভাবগ্রস্ত দুর্দশার সে দিনগুলো এখন শুধু অতীতের গল্প।

কৃষক মজিবরের জীবনে পরিবর্তনের শুরু হয় প্রায় ৮ বছর আগে। দেশী-বিদেশী কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় চর সারোডোবের দুয়েকজন কৃষক ততদিনে সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছেন। তাদের দেখাদেখি সনাতন কৃষি পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসেন মজিবর রহমানও। দেশী একটি এনজিও থেকে বীজ সংগ্রহ করে ৫০ শতক জমিতে ভুট্টার চাষ শুরু করেন তিনি। ভালো ফলন ও মুনাফার দেখা মেলায় প্রতি বছর ভুট্টা চাষের জমির পরিমাণ বাড়িয়েছেন তিনি। একক একটি ফসলে আটকে না থেকে বৈচিত্র্য এনেছেন চাষাবাদে। বর্তমানে ভুট্টার পাশাপাশি মরিচ, পেঁয়াজ ও কলার আবাদ করছেন মজিবর রহমান তিনি জানান কৃষি বিভাগের সহযোগিতা বাড়লে এখানকার কৃষকদের আরো ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে।


কয়েক বছর আগেও কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের কৃষকদের মারাত্মক অভাব-অনটনের মধ্যে দিন পার করতে হয়েছে। চরাঞ্চলের জমিতে তখন কাউন, চিনা, ধান, সরিষা ও গমের বাইরে অন্য কোনো ফসল আবাদ করা সম্ভব হতো না। উপরন্তু সনাতন পদ্ধতিতে আবাদ ও সেচের ব্যবস্থা না থাকায় ফলনও হতো অনেক কম। কিন্তু বর্তমানে এখানকার কৃষকরা উন্নত জাতের বোরো ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, গম, সরিষা, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম,আলু, টমেটো, মসুর ডাল, খেসারি ডাল, মুগডাল, মরিচ, পেঁয়াজসহ সবজি ও অন্যান্য ফসলও চাষ করতে পারছেন। কৃষি বিভাগসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় কৃষি পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে এগিয়ে চলেছেন চরাঞ্চলের কৃষকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।

এবিষয়ে কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মন্জুরুল হক জানান, চরাঞ্চলসহ জেলার ১ লাখ ১৯ হাজার কৃষককে কৃষি প্রণোদনার আওতায় উন্নত জাতের বীজ ও সার প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলের কৃষকদের বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনা মূল্যে বীজ ও সার দেয়ার পাশাপাশি লাভজনক ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে স্থানীয় কৃষি বিভাগ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

জেলা কৃষি বিভাগ সুত্রে জানাযায়, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকায় চর রয়েছে সাড়ে চারশর বেশি। এসব চরের মোট জমির পরিমাণ ৪৬ হাজার ৪২৮ হেক্টর। এর মধ্যে চাষাবাদ হচ্ছে ৩৫ হাজার ৮৭ হেক্টরে। এসব আবাদি জমির বেশির ভাগেই এখন লাভজনক ফসল ফলাচ্ছেন কৃষকরা। উৎপাদিত ফসল নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পর বিক্রি করছেন বাজারে।

চরাঞ্চলের জীবনমান পরিবর্তনে স্থানীয়দের কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে দুই শতাধিক এনজিও। বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় এসব এনজিও চরাঞ্চলের কৃষকদের লাভজনক ফসল চাষে উদ্বুদ্ধকরণে কাজ করে যাচ্ছে। বিনা মূল্যে সরবরাহ করছে উন্নত জাতের বীজ, সার ও কীটনাশক। বিভিন্ন ফসল, সবজি, ডাল ও তেলবীজ আবাদে সহায়তার পাশাপাশি এসব সংস্থা এখন গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনেও সহযোগিতা করছে। ক্লাইমেট অ্যাকশন নামে একটি এনজিও প্রকল্পের টিম লিডার মো. নাঈম খান জানান, তাদের সংস্থাটি বর্তমানে চরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভালোমানের সবজি বীজ বিতরণের মাধ্যমে তাদের তা চাষে উৎসাহিত করছে। এজন্য স্থানীয় কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতিতে জৈব সার ব্যবহার করে সবজি আবাদে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। স্থানীয়রা এসব সবজি আবাদের মাধ্যমে একদিকে যেমন নিজেদের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারছেন, তেমনি উৎপাদিত অতিরিক্ত সবজি বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবানও হতে পারছেন। এ কারণে সবজি চাষে স্থানীয়দের আগ্রহও ব্যাপকমাত্রায় বেড়েছে। এছাড়া সদস্যদের মুনাফাযোগ্যতা বাড়াতে তাদের ভেড়াও দিয়েছে সংস্থাটি। সবজি বীজ বিতরণ ও ভেড়া দেয়ার আগে এ নিয়ে উপজেলার কৃষি ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রশিক্ষণও দেয়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে অনেক সদস্যের ভেড়ার প্রজনন শুরু হয়েছে এবং কোনো কোনো সদস্য আগ্রহী হয়ে নিজ উদ্যোগে আরো ভেড়া কিনেছেন।

চিলমারী উপজেলার চর বজরা দিয়াখাতার বাসিন্দা মিনারা বেগম(৪০)ও যাত্রা করেছিলেন ফ্রেন্ডশিপ নামে স্থানীয় একটি এনজিও প্রকল্প থেকে শাকসবজি চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে। এছাড়া তাকে একটি ভেড়াও দিয়েছিল এনজিওটি। বর্তমানে তার ভেড়ার সংখ্যা আটটি। সবজি বিক্রি ও ভেড়া পালন করেই নিজ সংসারকে সচ্ছল করার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন মিনারা বেগম। সম্প্রতি তিনি একটি গরু কিনেছেন।

ওই এনজিওর প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, নিয়মিত আয়রোজগার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সদস্যদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রয়াস নিয়েছে তার সংস্থাটি। পাশাপাশি সামাজিক সুশাসন যেমন বাল্যবিবাহ রোধ, পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ ইত্যাদি নিশ্চিতে শিক্ষামূলক আলোচনা আয়োজনের পাশাপাশি দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সামাজিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়েও সংস্থাটি কাজ করছে।

আরও খবর

Sponsered content

error: ছি ! ছি !! কপি করার চেষ্টা করবেন না ।