তারাগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধিঃ 20 January 2021 , 12:54:12 প্রিন্ট সংস্করণ
তারাগঞ্জের বাছুরবান্দা গ্রামের ঢুকলেই চোখে পড়ে চকচকে লম্বা একটি টিনের ঘর । সাইনবোর্ডে লেখা কৃষি পাঠশালা। এখানে বসে থাকেন একজন মানুষ, নাম গিরিশ চন্দ্র (৫০), কীটনাশককে তিনি বলেন, সর্বনাশ বিষ এবং সেটা ব্যবহার করতে বারণ করেন। সেই সঙ্গে এ বিষ ছাড়াই কীভাবে ফল ও ফসলের পোকা দমন করা যায় তার পরামর্শ দেন । তাই এই লোকটির নাম এখন মানুষের মুখে মুখে। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত কৃষকেরা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসেন তার কাছে। গিরিশের পরামর্শে কৃষকদের এখন এদিক-ওদিক দৌড়াতে হয় না।
সপ্তাহে একদিন কৃষকদের নিয়ে ওই ঘরে বসে কৃষি পাঠশালা। কৃষি বিষয় নিয়েই পড়া-শুনা চলে এ পাঠশালায়। সংগ্রামরত গিরিশের গড়া এ পাঠশালাটি বিদেশীরা পরিদর্শন করে অভির্ভূত হন। কৃষি কর্মকর্তারা বিভিন্ন জেলার কৃষকদেরকে এনে তার কর্মকান্ড দেখাচ্ছেন।
সবাইকে তিনি একটি কথাই বিশেষ ভাবে বলছেন- তা হল জমিতে ফলন বাড়ানো, কীট-পতঙ্গ দমন করতে কোন কিছুতেই কীটনাশক ব্যবহার করা ঠিক নয়। গিরিশ চন্দ্র সেই সঙ্গে সবাইকে ফল গাছ রোপনের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বনজ গাছ লাগালে শুধু কাঠই পাওয়া যায়। তাই উপযুক্ত জায়গা পেলেই ফলের গাছ লাগাতে হবে। এতে ফল এবং কাঠ দুটোই পাওয়া যাবে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সচেতন এ মানুষটি এলাকায় বিনামূল্যে গাছের চারা, সবজি বীজ বিতরণ করেন।
যেখান থেকে শুরু
২০ বছর আগের কথা। গিরিশের দুটি ছাগল হঠাৎ মাারা যায়। বিষয়টি গিরিশকে ভীষনভাবে নাড়া দেয়। কিভাবে তার ছাগল মারা গেল তার খোঁজে নামেন তিনি। শেষে গ্রামের কৃষক আবু বক্করের কাছে জানতে পারেন, কীটনাশক ছিটানো সবজী ক্ষেত খাওয়ায় ছাগল দুটি মারা যায়।
এ ঘটনাটি গিরিশের ভাবনার জগতটিকেই নাড়িয়ে দেয়। নিজেই প্রতিজ্ঞা করেন, ফসল ফলাতে ক্ষেতে কীটনাশক ছিটাবেন না। রাসানিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই তিনি ১৯৯৯ সালে ১০ শতকে লাগান করলার ক্ষেত। গংগাচড়া উপজেলার লালচাঁদপুর গ্রামের এনামুল হকের পরামর্শে পোকা দমনে ক্ষেতে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করেন। দেখতে দেখতে করলার ক্ষেত সবুজে ভরে উঠে। বিক্রি করে খরচ উঠেও লাভ থাকে ৮ হাজার টাকা।
সাহসী এই উদ্যোগের কথা জানতে পেরে সহযোগীতার হাত বাড়ান তাৎকালীন তারাগঞ্জের কৃষি কর্মকর্তা আলী আজম। তিনি আই.পি.এম পদ্ধতিতে পরিবেশ বান্ধব বালাই নাশক ব্যবহার সহ আধুনিক পদ্ধতিতে চাষবাসের উপর এক মাস তাকে প্রশিক্ষন দেন।
তখন চারিদিকে কীটনাশকের উপকারিতার জয়গান। বাড়ি এসে কয়েকজনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু কেউ তার পরামর্শ শুনতে রাজি নয়। অনেক বুঝিয়ে তার চাচাতো ভাই অতুল চন্দ্র ও প্রফুল চন্দ্রকে রাজি করেন। তারা ২০ শতক জমিতে করে উন্নত জাতের করলা লাগান। পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহার না করে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করেন। এতে ফলন ভাল হয়। প্রতিটি করলার ওজন হয় ৪০০-৫০০ গ্রাম। এ বিষয়টি জানতে পেরে অন্য কৃষকরা করলা ক্ষেত দেখতে আসেন। তারাও গিরিশের পরামর্শে ফসল চাষ করতে চান। ২০০০ সালের গিরিশ নিজের টাকায় ৪০ হাত একটি টিনের ঘর তোলেন। সেখানে চালু করেন কৃষি পাঠশালা।
পাঠশালার কথা
বই নেই খাতাও নেই। শুধু শ্রবণ শক্তি দিয়ে পাঠশালায় বিদ্যা অর্জনের একমাত্র মাধ্যম। গিরিশ বলেন, আর কৃষকেরা শোনেন। আবার কৃষকেরা বলেন তিনি শোনেন। এলাকার সব বয়সের নারী-পুরুষেই শিখতে আসেন গিরিশের এই কৃষি পাঠশালায়। ক্ষেত-খামারে পোকা আক্রমন, জমি তৈরী, পরিমিত সারের ব্যবহার, বীজ সংরক্ষন, কম্পোষ্ট সার তৈরীসহ সব কিছু সম্পর্কে জানেন এখানকার কৃষকেরা। কোনটি আসল সার আর কোনটি বা ভেজাল সার তাও জানেন তারা। এছাড়াও কোন জাতের গাভীর দুধ সরস, কিভাবে মজা পুকুর সংস্কার করে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে ভাল ফলন মেলে তাও শিখেছেন তারা এ পাঠশালায় এসে। কোন ধরণের বেতন- ভাতা ছাড়াই চলে এই পাঠশালার কার্যক্রম। শতাধিক কৃষকের নিয়মিত পাঠের আসর বসে এখানে। সপ্তাহে বৃহস্পতিবার নীরবে শোনেন গিরিশের কথা।
পাঠশালায় একদিন।
সরেজমিনে দেখা গেল ১৫ শতক জমিতে তোলা আছে পাঠশালাটি। চারিদিকে গাছ- গাছালিতে ভরা। ৯ রকম ফল গাছ সেখানে। অনেক গাছেই ধরে আছে নানান জাতের ফল। ৬ রকম ঔষধি গাছও আছে। রয়েছে কয়েক রকমের মসলার গাছ। পাঠশালার পেছনে ৬০ শতক আয়তনের একটি পুকুর। এতে চলছে মাছ চাষ। এভাবে গাছ লাগানো ও মাছ চাষে গ্রামের কৃষকদের হাতে- কলমে জ্ঞান দেওয়ার আয়োজন করেছেন গিরিশ।
কৃষকদের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে তুলতে পাঠশালার বারান্দা ও ভেতরে বেশ কিছু পোস্টার টাঙ্গানো রয়েছে। সেখানে রয়েছে কোন পোকা ফসলের জন্য ক্ষতিকর আর কোনটি ফসলের জন্য সহায়ক তার ছবি। পাঠশালার সামনে কৃষকদের নানান বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন গিরিশ চন্দ্র। সেখানে গাভীর সমস্যার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে আসেন গ্রামের কৃষক হরিপদ রায়, খগেন রায় আসেন লিচু গাছের পাতা কেন কুকড়ে যাচ্ছে এ পরামর্শ নিতে। এলাকার সবজি চাষী মেনাজুল ইসলাম বলেন, গিরিশ দাদার কাছ থেকে সবসময় কৃষি বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ পাই।
গ্রামের কৃষক সোলেমান, আবুজার জানান, পাঠশালায় শিখে তারা এখন মান সম্মত ধানের বীজ উৎপাদন করছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব বীজ কিনে নেন। গত বছর তারা ৩০০ মন ধান বীজ বিক্রি করেছেন।
নদীরপাড় গ্রামের কৃষক মুকুল মিয়া বলেন, ফসল ফলাইতে হামাক এলা ঔষুধ লাগেছে না, ধানের ক্ষেতোত ধইঞ্চার বিচি ছিটাই, কঞ্চি গাড়ি দেই, সবজির ক্ষেতোত সেক্স ফেরোমন ফাঁদ বসাই। ধইঞ্চার গাছত ও কঞ্চাইত বসি পাখি পোকা খায়, সেক্স ফেরোমন ফাঁদত আটকি পুরুষ পোকা মরি যায়।
গ্রামের গৃহিনী মনোবালা বলেন, গিরিশ দাদা হামার গ্রামের লক্ষী, অর জন্যে গ্রামত অভাব নাই। সোবায় কাইঞ্চা খুলিত শাক সবজি, ক্ষেতের আইলোত আম, কাঠাল, পেঁপে ও লিচুর গাছ লাগাইছে।
ক্ষেতে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ
পাঠশালার পাশে কমুড়া ক্ষেতে দেখা গেল সারিবদ্ধ ভাবে দুটি চিকন খুঁটির উপর একটি করে প্লাষ্টিকের কৌটা বসানো আছে। প্লাস্টিকের কৌটার দুই দিকে দুটি জালানা কাটা আছে এবং কৌটার ভেতর জালানা বরবার একটি ফেরোমন লিউর ঝুলানো আছে।পুরুষ পোকা স্ত্রীপোকা হতে নিঃসৃত যে গন্ধের কারণে আকৃষ্ট হয়ে মিলিত হওয়ার জন্য স্ত্রী পোকার দিকে ধাবিত হয় সেই গন্ধ কৃত্রিমভাবে ফেরোমন লিউর- এ থাকায় পুরুষ পোকা প্লাষ্টিকের কৌটার দিকে ধাবিত হয়ে কৌটায় রক্ষিত সাবান মিশ্রিত পানিতে পড়ে মারা যায়। পুরুষ পোকা মারা যাওয়ায় পোকার বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হয় এতে বিষ প্রয়োগ ছাড়াই ক্ষেতের ফসল তড় তড় করে বাড়ে।
কৃষকদের নিয়ে সমিতি গঠন
গিরিশ চন্দ্র কৃষকদের একজোট করে বানিয়েছেন বাছুরবান্দা কৃষক সমবায় সমিতি। প্রতি সপ্তাহে ১৬০জন সদস্য ১০ টাকা করে সমিতিতে সঞ্চয় দেন। এটাকা থেকে তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে সহজ শর্তে ঋণ নেন।
সম্পাদক বাহাদুর রায় বলেন, সমিতির তহবিলে এখন ৭ লাখ টাকা আছে। গ্রামে স্থাপন করা হয়েছে তিনটি নলকূপ। রাস্তায় লাগানো হয়েছে ১৫ হাজার ফলের গাছ। ৪০ টি বকনা বাছুর কিনে বর্গা দেওয়া হয়েছে। পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষও চলছে। এসব খাত থেকে আসা আয় শুধু সদস্যরাই ভাগ করে নেন তা নয়, গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করাও হয়।
গিরিশের জীবন জীবিকা
বাছুরবান্ধা গ্রামের ১৯৬০সালে গিরিশের জন্ম। স্ত্রী ,দুই মেয়ে, ও এক ছেলে পাশাপাশি ৭০শতক জমিতে লাগানো অজস্র ফলজ গাছ পালাই তার প্রিয় জন। ছেলে লিটন চন্দ্র বিয়ে হয়েছে মেয়ে রিফা রানী ও অন্তরা রানী কলেজে পড়ছে। ফল আর ফসল বিক্রির আয় দিয়ে তার সংসার চলে। গত ১০বছরে তিনি ১০হাজার ফলজ গাছের চারা এলাকাবাসীর মধ্যে বিতরন করেছেন।
গিরিশ বলেন, যে জিনিস দিয়ে পোকা মড়ে তা অবশ্যই মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর। তাই সপ্তাহে একদিন পাঠশালায় এবং অন্য দিন এলাকায় ঘুরে ঘুরে কথা বলেন, মরনবিষের বিরুদ্ধে।
গিরিশ এলাকার গর্ব
ইকরচালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোবারক হোসেন বলেন, গিরিশ আমাদের গর্ব। তার অবদানকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সমির চন্দ্র ঘোষ বলেন, গিরিশের কর্মকান্ডে আমরা মুগ্ধ। তাকে আদর্শ কৃষকের পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
কৃষি স¤প্রসারন কর্মকর্তা মাজেদুল ইসলাম বলেন, আফ্রিকার দেশ ‘ইথিওপিয়া’ থেকে সে দেশের কৃষি মন্ত্রনালয়ের সচিব ট্যামরাট সেগাইয়ি সহ ৮জন কর্মকর্তার একটি দল গত ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশে এসেছিলেন । গিরিশের পাঠশালার কথা শুনে তারা না এসে পারেন নি। পাঠশালা পরিদর্শন বইয়ে তারা এই পাঠশালার কর্মকান্ডকে একটি ব্যতিক্রমী চমৎকার উদ্যোগ বলে উলেখ করে। এছাড়াও পাঠশালাটি পরিদর্শন করে কৃষি স¤প্রসারন অধিদপ্তর ঢাকার মহাপরিচালক তারিক হাসান সহ অনেকেই মুগ্ধ হন। গত মার্চ মাসে কৃষি স¤প্রসারন অধিদপ্তরের রংপুরের পীরগঞ্জ, পীরগাছা কার্যালয়ের উদ্যোগে স্থানীয় কৃষকদের ওই পাঠশালায় পরিদর্শনে আনা হয়।