সারাদেশ

ভূরুঙ্গামারীতে লাইসেন্স বিহীন ইটভাটার আগুনে উতপ্ত ফসলি জমি: অবাধে চলছে শিশুশ্রম 

  কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ  18 February 2021 , 7:09:18 প্রিন্ট সংস্করণ

ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষিজমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লাইসেন্স বিহীন ইট ভাটা। এসবের নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও। শিশুশ্রম আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হলেও ইট ভাটা গুলোতে অবাধে চলছে শিশুশ্রম। ভাটার তপ্ত আগুনে পুড়ছে ফসলি জমির উর্বর মাটি। ইট ভাটার কুন্ডলী পাকানো কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত কালো ধোঁয়ার বিষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। যত্র তত্র ইটভাটার কারণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে এলাকার পরিবেশ।
জানা গেছে উপজেলায় ইটভাটা আছে ১০ টি। উপজেলা সদরের আশেপাশে এলকার কৃষিজমিতে এসব ইটভাটা গড়ে উঠেছে। সেগুলো হল মেসার্স ফ্রেন্ডস ট্রেডার্স, খোকন ট্রেডার্স ১ ও ২ পিএসকে ও এল টি বি সহ আরো পাচটি।
জানা গেছে, ইট পুড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাহাড়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং লোকালয় থেকে ৩ কি.মি. দুরত্বের মধ্যে কোন ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। এছাড়াও কৃষিজমিতে ইটভাটা তৈরীর আইনগত বিধি নিষেধ থাকলেও কৃষিজমি, ও ঘনবসতিপুর্ণ এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে এসব ইট ভাটা স্থাপন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রায় সব ইটভাটাতেই ১৮ বছরের কমবয়সী শিশুরা ইট তৈরি ও পোড়ানোর কাজ করছে। স্কুল ও মাদ্রাসা গুলো বন্ধ থাকায় স্কুল পড়ুয়া কম বয়সী শিশুরা টাকার লোভে শিশুশ্রমে ঝুকে পরছে। কম টাকায় শিশু শ্রমিক পাওয়ায় এতে ভাটার মালিকরাও সুযোগ নিচ্ছে।  ১৮ বৃহস্পতিবার ফেব্রুয়ারি সরেজমিন গিয়ে এর সত‍্যতাও পাওয়া যায়। মেসার্স ফ্রেন্ডস ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা যায় উপজেলার পাটেশ্বরী বহুমুখী উচ্চ বিদ‍্যালয়ের ৮ম শ্রেনীর ছাত্র আবু বক্বর সিদ্দিক ৭ম শ্রেনীর ছাত্র আশরাফ ভূরুঙ্গামারী সিনিয়র মাদ্রাসার ৬ষ্ট শ্রেনির ছাত্র আরমান ও ২ নং পাইকেরছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ের ৪র্থ শ্রেনীর ছাত্র মোবারক সহ আরো অনেক শিশুকেই কাজ করতে দেখা যায়। শিশুরা জানায়, তারা এক লাইন ইট উল্টালেই ত্রিশ টাকা মজুরি পায়। তারা প্রতিদিনই এই কাজ করে থাকে। এসময় ইটভাটায় শিশুরা কাজ করছে এ বিষয়ে ফ্রেন্ডস ট্রেডাসের্র মালিক ফজলুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান। শুধু তাই নয় ভাটায় নিয়োজিত শ্রমিকদের নেই কোন স্বাস্থ‍্য সুরক্ষাও।
 ইটভাটা গুলোর আশে পাশের এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ইট ভাটায় বিপুল পরিমান ফসলি জমি নষ্ট করে ইট তৈরি করছে। বেশ কয়েকটি ট্রাক্টর দিয়ে কৃষি জমির টপ সয়েল (জমির উপরিভাগের মাটি) এনে ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তাছাড়াও এসব ইটভাটার পাশেই আছে কৃষিজমি। ইটভাটার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভাটা প্রতিষ্ঠাকালে এলাকাবাসী প্রশাসনের কোন দপ্তরে অভিযোগ দিতে সাহস পায়নি। গত কয়েক বছর থেকে ভাটায় ইট উৎপাদন ও বিক্রির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের লাইসেন্সসহ কোন কাগজপত্রই নেই।  ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করেই ভাটাগুলো চলছে। ভাটার পাশে স্তুপ করে রাখা হয়েছে মাটি। ভাটার জন্যে ব্যবহারকারী ট্রাক ও ট্রাক্টরের ঘন ঘন যাতায়াতের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে পথচারীসহ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এর কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ হচ্ছে বিনষ্ট, নষ্ট হচ্ছে ফসল।
ইটভাটা এলাকার কৃষক  আশরাফ, করিম ও জব্বার মিয়া বলেন, গত কয়েক বছর আগেও এই জমিতে আমরা ফসল উৎপাদন করেছি। এখন সেখানে তৈরি করা হয়েছে ইট ভাটা। এতে শুধু কৃষি চাষাবাদ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভাটায় ব্যবহৃত চিমনি দিয়ে নির্গত ধোয়ায় কয়েকশ বিঘা ফসলি জমি হুমকির মুখে পড়েছে।
 ভূরুঙ্গামারী উপজেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির আহবায়ক ও কাজি ব্রাদার্স ব্রিক্সের স্বত্বাধিকারী কাজি মোস্তফা বলেন, আমার জানামতে পাচটি ইটভাটার লাইসেন্স আছে কিন্তুু পরিবেশ অধিদপ্তর কারো ইটভাটার নবায়ন দিচ্ছেনা। তাই চলতি বছর ভাটার কোন লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। শিশু শ্রমের বিষয়ে তিনি জানেন না বলে জানান।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এ এস এম সায়েম বলেন, ইটভাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা স্বাস্থ্য বিধি না মেনে কাজ করলে তাদের  শ্বাসকষ্ট, ডাচ এলার্জি, ও ফুসফুসের সংক্রমন সহ বিভিন্ন ধরনের রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, অপরিকল্পিত ভাবে ইট ভাটা গড়ে ওঠায় বিপুল পরিমান কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। এসব ভাটায় ইট তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে ফসলি জমির টপ সয়েল। ফলে একদিকে কৃষক হারাচ্ছে বড় অংশের কৃষি উপযোগি জমি অন্য দিকে ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদনের লক্ষমাত্রা পুরণ না হওয়ার সম্ভবনা দেখা দিতে পারে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মা বলেন, এ উপজেলায় ১০ টি ইটভাটা রয়েছে।ভাটার লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয় জানেন। কোন ইট ভাটায় শিশু শ্রম হয়ে থাকলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব‍্যাবস্থা নেয়া হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের সহকারি পরিচালক ইউছুফ আলী বলেন, ভূরুঙ্গামারী উপজেলার কোন ইটভাটারই পরিবেশ অধিদপ্তরের হালনাগাদ ছাড়পত্র নেই। শুধুমাত্র খোকন ট্রেডার্স নামের ইটভাটাটির ১৭ জানুয়ারি ২০ সাল পর্যন্ত ছাড়পত্র ছিল। এখন একটিরই নেই। ইতোমধ্যে আমরা কয়েকটি উপজেলায় বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম‍্যমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়েছি। আমরা সব উপজেলাতেই এই ধরনের অভিযান চালাব। কেউ যদি আইন অমান্য করে ইটভাটা চালায় তা হলে সঠিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোঃ রেজাউল করিম বলেন, ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দশটি ইটভাটার মধ্যে সাতটির লাইসেন্স নবায়ন আছে। শিশু শ্রমের বিষয়টি নিয়ে মালিক সমিতির সভাপতি কে চিঠি দেয়া হবে। এর পরেও বিধিমালা লংঘন করে কেউ ইটভাটা পরিচালনা করলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

আরও খবর

Sponsered content