রংপুর

মাছ চাষে ভাগ্য বদল

  তারাগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি 20 January 2021 , 12:36:44 প্রিন্ট সংস্করণ

এক সময় গ্রাম জুড়ে দেখা যেত ধান ক্ষেত আর ধান ক্ষেত। এখন সেই গ্রাম জুড়ে শুধুই চোখে পড়ে পুকুর আর পুকুর। প্রতিটি পরিবারে রয়েছে কম বেশি মৎস্য খামার। যারা এক সময় অন্যের বাড়ীতে শ্রমিকের কাজ করতেন। আজ তাদের প্রত্যেকের কাছে আছে মাছ চাষের বদোলতে পাওয়া লক্ষ লক্ষ টাকা। আর যাদের কোন টিনের ঘর ছিল না এখন তাদের বাড়িতে রয়েছে ইটের ঘর। বসত বাড়ির পতিত অংশে হলুদ, আঁদা, মরিচ, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ধরনের সব্জির বাগান।

মাছ আর মসলা জাতীয় ফসলে ঘেরা এই গ্রামের নাম কুর্শা কাজীপাড়া। এগ্রামের মানুষের ভাগ্য বদল হওয়ার পিছনে লুকিয়ে আছে এক যুবকের সংগ্রামের কাহিনী। আজহারুল ইসলাম নামের এই যুবকের মাছ চাষের সফলতা দেখে গ্রামটির মানুষ একের পর এক মাছ চাষে ঝুকে পড়েন। ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম জুড়ে মাছের চাষ। এক সময় মাছের কল্যানে গোটা গ্রাম থেকে পালিয়ে যায় অভাব। গ্রামটি পরিচিতি পায় মাছের গ্রাম হিসাবে।

মাছের গ্রামে একদিন
তারাগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১ কিঃ মিঃ দক্ষিণে এই গ্রামটির অবস্থান। লোক সংখ্যা ৭শত, পরিবার সংখ্যা ১৮০। এই গ্রামেরই যুবক আজহারুল ৩২। স¤প্রতি তার বাড়িতে যাওয়ার পথে ওই গ্রামে ঢুকেই অভাবিত দৃশ্য চোখে পড়ে। গ্রামের মাঠ জুড়ে অসংখ্য পুকুর। প্রতিটি বাড়ীর উঠানের পাশে আঁদা, হলুদ, মরিচ, পেয়াজ আর সব্জি ক্ষেত। উঠানে মুরগী পুকুরে মাছ ও গোয়ালে গরু ছাগল। গ্রামটির সব নারী পুরুষকেই দেখা গেল কর্মব্যস্ত। কেউ পুকুরে মাছ ধরছে, কেউ মাছের খাদ্য তৈরী করছে। প্রতিটি বাড়ীতে দেখা গেল স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ও বিশুদ্ধ পানি জলের ব্যবস্থা। ঘরে ঘরে আছে বিদ্যুৎ সংযোগ ও টেলিভিশন। আজাহারুলের বাড়ীতে গিয়ে দেখা গেল তিনি জেলেদের সাথে পুকুরে মাছ ধরছে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে পুকুর থেকে উঠে এসে পুকুর পাড়ে বসতে দিলেন। এরপর তার মাছ চাষের গল্প শোনালেন।
আজাহারুলের সংগ্রাম।

৬ বোন ৪ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আজহারুল । বাবা আফতাব উদ্দিন ৬ মেয়ের বিয়েতে সব জমি-জমা বেচে দেয়। অভাবের কারনে শেষ সম্ভল ৫০ শতকের একটি পুকুর সেটাও অন্যকে লীজ (বন্দক) দেয়। ২০০০ সালে তিনি মারা গেলে সংসারে দেখা দেয় অশান্তি। বড় ভাইরা প্রত্যেকে আলাদা হয়ে যায়। মা ফাতেমাকে নিয়ে বিপাকে পড়েন আজহারুল। অনেক ভেবে চিন্তে পাশের সয়ার ইউনিয়ে আমজাদের মৎস্য খামারে কাজ নেন।

আজহারুল বলেন, মৎস্য খামারে ১ বছর কাজ করার সময় মাছ চাষের কৌশল তিনি শেখেন। ১বছরের মজুরী ২৪ হাজার টাকার ১০ হাজার দিয়ে বাবার লীজ দেওয়া পুকুরটি বের করেন। বাকী ১৪ হাজার টাকায় মাছের খাদ্য ও পাবর্তীপুর মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার থেকে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, সরপুটির পোনা এনে পুকুরে ছাড়েন। প্রথম বছরেই তার লাভ হয় ৪৫ হাজার টাকা। এর পর পুকুরের আয়তন বাড়ীয়ে দেন। লীজ নেন আরোও ৪টি পুকুর।

৫টি পুকুরে মাছ চাষ করে খরচ বাদে লাভ করেন ১লাখ ৭০ হাজার টাকা। এবার তিনি মাছ চাষের পাশাপাশি শুরু করেন পোনা মাছা বিক্রির ব্যবসা। ব্যবসায় সাফল্য আসে। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে মাছ চাষ ও পোনা বিক্রি করে আয় করেন প্রায় ৩লাখ টাকা। এ টাকায় তিনি লীজ নেওয়া পুকুর চারটি কিনে নেন।

এখন ১০ টি পুকুরে মাছের চাষের পাশাপাশি পোনা মাছ বিক্রির ব্যবসা করছেন। তার খামারে কাজ করেন দৈনিক ৬ জন লোক। মাছ ও পোনা বিক্রির আয়ের টাকায় পাকা বাড়ী করেছেন। কিনেছেন মোটরসাইকেল দেড় একর জমি কিনে করছেন হলুদ, আঁদা, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন সব্জির চাষ। আজহারুলের মাসিক আয় এখন গড়ে ৩০ হাজার টাকা।
আজহারুলের পথ ধরে।

নিজের সংসারে স্বচ্ছলতা আনার পাশাপাশি গ্রামের আর ১০ জনের কথাও ভুলে জাননি আজাহারুল। তাদেরও পরামর্শ প্রয়োজনে নিজে প্রশিক্ষণ দিয়ে মাছ চাষে উৎসাহিত করেছেন। তার দেখা-দেখি গ্রামটির অনেকে মাছ ও পোনা বিক্রির ব্যবসা করে স্বাবলম্বি হয়েছেন। এ গ্রামে এখন কম বেশি সবার পুকুর রয়েছে। বাড়ীর পাশে তারা আঁদা, হলুদ, পেয়াজ সহ সব্জির চাষ করছেন।

মইনুল, জব্বার, মোকলেছুর, মোস্তাফিজারের এখন মাছ চাষ করে মাসিক ১০-১২ হাজার টাকা আয়। আজহারুলকে মডেল ধরে ওই গ্রামের নুর আলম, রেজাউল, রাশেদুল, মোস্তফা, নুর মোহাম্মদ, ছাদেকুল, আছাবুদ্দিন, মেরাজুল, খালেকসহ অনেকেই মাছের খামারের মালিক।
অনেক ঘোরা-ঘুড়ি করে চাকুরী না পেয়ে শিক্ষিত যুবক মমিনুল ইসলাম ২০০৪ সালে পৈতৃক জমির সঙ্গে ২টি পুকুর লীজ নিয়ে গড়ে তোলেন মৎস্য খামার। চাষ করতে থাকেন রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, সিলভার কার্প। আর ঘুরতে থাকে ভাগ্যের চাকা। এক সময় লীজ নেওয়া পুকুর ২টি কিনেন। পৈতৃক জমিতেও খনন করেন আরও ২টি পুকুর। ২০০৯ সালের মাছ চাষের আয়ের টাকায় করেন পাকা বাড়ী। এখন ৫টি পুকুরে মাছ চাষ ও পোনা বিক্রির ব্যবসা করছেন।

কৃষক আব্দুর রহমান তার ১ একর জমিতে শুধু ধান চাষ করে ৯ সদস্যের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতেন। আজহারুলের দেখে ২০০৪ চালে ৫০ শতক জমিতে ১টি পুকুর খনন করে মাছ ও বাড়ীর পাশে হলুদ, আঁদা, বেগুনের চাষ করে ১ বছরে ৮০ হাজার টাকা আয় করেন। এ টাকাও আর একটি পুকুর খনন করে এখন ২টি পুকুরে মাছের চাষ করে বছরে ১ লক্ষ টাকা আয় করছেন।
বিয়ের পর ২০০৩ সালে বছিরকে আলাদা করে দেয় ভাইয়েরা। ভাগের পওয়া বাবার ৩০ শতকের একটি পুকুরে মাছের চাষ শুরু করেন তিনি। এখন ৪টি পুকুর, নিজের বাড়ী, আবাদী জমি হয়েছে। গাছপালা ঘেরা বাড়ীতে হাঁস-মুরগী, গাভী ও পুকুরে মাছ চাষ করে সুখের সংসার তার।

৩টি পুকুর খনন করে ৫বছর মাছের চাষ করে পাকা বাড়ী ও ১ একর জমির মালিক হয়েছেন মোস্তফা। তিনি বলেন, মাছ চাষে লাভ বেশি পরিশ্রম কম। ৫০ শতক জমির একটি পুকুরে মাছ চাষ করতে খরচ হয় ১৪-১৫ হাজার। মাছ বিক্রি করা যায় ৬০-৬৫ হাজার।
পোনা উৎপাদনকারী কাজী ফারুক হোসেন জানান, মাছ চাষের চেয়েও পোনার ব্যবসায় লাভ বেশী। ১ কেজি পোনা ৪হাজার টাকায় কিনে এনে আরোও ৮হাজান টাকা খরচ করে ১বিঘায় ৬০ শতক জমির একটি পুকুরে ২০দিন লালন-পালন করে ৩০হাজার টাকা বিক্রি করা যায়। রেনু ছাড়ার ৭-১০দিন আগে পুকুরে চুনাপাথর, রাসায়নিক ও জৈব সার দিতে হয়। কয়েকদিনের মধ্যে পানির রং নীল হলে সর্বোচ্চ ২দিন বয়সী রেনু অক্সিজেনের ব্যাগে করে এনে পুকুরে ছাড়তে হয়। পোনা একটু বড় হলে পরিমাণ মত খাবার দিতে হয়। ২০-২৫ দিন পর রেনু ধানের সমান পোনা হলে বিক্রি করা যায়।

পাশের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের জেলে ফয়জুল ইসলাম জানান- সারা বছরে মাছ তুলতে তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। একটি পুকুর থেকে ১বার মাছ ও পোনা তুলতে তারা ২০০-২৫০ টাকা নেন।
সাইকেলে করে ঘুরে ৫ বছর যাবত পোনা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন ছাইফুল ইসলাম, নজরুল, একাব্বর, জিয়াউল হক। তারা জানান- ৫-৮শত টাকায় ৫-৮কেজি পোনা কিনে সাইকেলে ফেরি করে পাশের উপজেলায় বিক্রি করলে তাদের দৈনিক গড়ে লাভ হয় ৩-৪শত টাকা । ৬ মাস পোনা বিক্রির আয় দিয়ে তাদের ১বছরের সংসারের খরচ চলে।

উপজেলা মৎস্য কর্মর্কতা দিপা রানী বলেন, আজহারুল সকল মাছ চাষীর মডেল। মৎস্য বিভাগ থেকে তাকে পরামর্শ দেওয়া হয়। তার দেখে গ্রামটির অনেকেই মাছ চাষে ভাগ্য বদল করেছে। এই গ্রামের মাছ ও পোনা বাইরের জেলায় রপ্তানী করা হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তা অমির চন্দ্র ঘোষ বলেন, দিন দিন গ্রামটিতে মাছ চাষের পাশাপাশি মসলা জাতীয় ফসল ও সব্জির চাষ বেড়েই চলেছে। অন্য ফসলের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় লোকজন হলুদ, আঁদা, রসুন, পেঁয়াজ, বেগুন, মরিচের চাষ করছে।এই গ্রামের উৎপাদিত মসলা জাতীয় ফসল ঢাকায় যাচ্ছে।

 

আরও খবর

Sponsered content

error: ছি ! ছি !! কপি করার চেষ্টা করবেন না ।