তাঁরা সবাই শিক্ষার্থী। কেউ পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ পড়েন মেডিকেল কলেজে। ধর্ম, বর্ণ, মন মেজাজে ভিন্নতা থাকলেও ব্রত তাদের একটাই। দারিদ্র্য মানুষের উপকার করবেন, বিপন্নদের পাশে দাঁড়াবেন। এই ব্রত সামনে রেখে তাঁরা প্রায় তিন বছর আগে একটি সংগঠন করেন। সেই থেকে বিভিন্ন কল্যাণমুখী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার এই স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনের নাম ‘মানব কল্যাণ ঘর’। তিন বছর আগে মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য ঢাকার বাসিন্দা এ,এ মনিরুজ্জামানের পরামর্শে সংগঠনটি গড়ে তোলেন ৬৫জন মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। সেই থেকে সংগঠনটি বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের সদস্যরা দরিদ্র পরিবারের মেয়ের বিয়েতে সহায়তা, গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ, দুস্থদের গাভি ও ভ্যান প্রদান, শীর্তাতদের শীত বস্ত্র প্রদান, মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহায়তা করে চলেছেন।
আজ শনিবার সংগঠনটির উদ্যোগে মনিরুজ্জামানের সহায়তায় ২২৩টি দুস্থ ও অসহায় পরিবারকে ঈদ উপহার হিসেবে খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ইকরচালী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সকাল ১০টায় এই সব ঈদ উপহার বিতরণ করা হয়। প্রতিটি পরিবারকে এক কেজি আতপ চাল, ৫ কেজি সিদ্ধ চাল, ১ লিটার তেল, ১ কেজি মুসুর ডাল, ১ কেজি ছোলা বুট, ২ কেজি আলু, ১ কেজি পেয়াজ, ১০০গ্রাম মরিচ, ৫০০গ্রাম লবণ, ১ কেজি সেমাই, ১ কেজি চিনি, ১ কেজি গুড়, দুইটা আপেল, ২৫০গ্রাম খেজুর, ২৫০ গ্রাম মুড়ির ও একটি সোনালী মুরগিসহ একটি প্যাকেজ দেয়া হয়। খাদ্য সমাগ্রী হাতে পেয়ে তা বহন করতে পারছিলেন না মাটিয়ালপাড়া সেচ গ্রামের ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, ‘বাবা রোজার মাসটা কষ্টে গেলো। ঘরোত খাবার আছলো না। পাশের বাড়িত য্যায়া মাঝে মধ্যে খাছুন। আর কয়দিন পর ঈদ খুব চিন্তায় আছনু ঈদোত কি খাইম। কিন্তু তোমরা ইগল্যা ডাকে আনি মোক মুরগি আর চাল, ডাল ইফতার দিনেন। এইগ্যা দিয়া মোর ১০ দিন চলি যাইবে।’
ফাতেমার পাশেই খলেয়া নন্দরাম প্রামানিকপাড়া গ্রামের আক্তারা বেগম আঁচলে চোখ গড়িয়ে পড়া পানির ফোঁটা মুছে বলেন, ‘ভাইজান, ভিজিএফের ১০ কেজি চাল মোর স্বামী মেম্বারেরটে চাছলো জন্যে ওমাক মেম্বার খুব মারধর করছে। স্বামী মোর এ্যালাও হাসপাতালোত। ঘর খাবার নাই, স্বামীর চিকিৎসা করার টাকা নাই। মোর দুঃখের কথা শুনি তোমরা ডাকে আনি আতপ চাল, ভাতের চাল, তেল, মুসুর ডাল, বুট, আলু, পিয়াজ, মরিচ, লবণ সেমাই-চিনি, গুড়, দুইটা আপেল, খেজুর, মুড়ি ও জেন্ত একটা মুরগি দিনেন। আল্লাহ তোমার ভালো করবে। ঈদের দিন ছাওয়া দুইটাক ধরি শান্তিতে খাবার পাইম।’ ঈদ উপহার পেয়ে দু’হাত তুলে দোয়া করেন বৃদ্ধা অলিমা বেগম। তিনি বলেন, ‘বাবা মোর থাকার ঘর আছলো না। মনিরুজ্জামানের টাকাত সংগঠনের সদস্যরা মোক ঘর বানে দিছে। এ্যালা নয়া ঘরোত থাকোং। আইজ ডাকে আনি চাল-ডাল, মুরগি ইফতার আর সেমাই দিলে। ঈদের দিন তাক আন্দি শান্তি মতো খাইম।’
ঈদ সামগ্রী হাতে পেয়ে একাই বহন করতে পারছিলেন না জুম্মাপাড়া গ্রামের মহুবোন বেওয়া। তাকে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন সংগঠনের এক সদস্য। ঈদ উপহার ভ্যানে তুলে মহুবোন বেওয়া বলেন, ‘বাবারা অনেকগুলা খাবার দিছে মুই ভাসারে পাওছুন না। খালি ঈদের দিন নোয়ায়, ১০দিন আর মোক ভিক্ষা করির যাবার নাগবে না।’ পোদ্দারপাড়া গ্রামের রওশনারা মাঠে খুলে দেখেন ঈদ সামগ্রী। এ সময় আনন্দে চকচক করছিল তাঁর চোখ মুখ। তিনি বলেন, ‘একটা সংসারোত খাইতে যা নাগে সউগ দিছে। ঈদোত মেয়ে জামাই আন্দি খিলার পাইম। এগল্যা না পাইলে খুব কষ্ট হইল হয়।’
চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের চিনি মাই বলেন, নয়া বিয়াও হবার পর বাপ প্রত্যেক বছর ঈদের আগোত এমতোন সওদা দিছলো। বহুদিন হইল বাপ, স্বামী মরি গেইছে। ভিক্ষ করি খাও। আইজ তোমরা এইগল্যা দিয়া মোর বাপের কাম করনেন। আল্লাহ তোমার ভালো করবে। শেখপাড়া গ্রামের বৃদ্ধা মঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ‘বাবা মুই খুব খুশি। ঈদের আগোত তোমার এগ্যাল মোর খুব কামোত নাগবে। মুই কোনো দিন এই ঋণ শোধ করির পাইম না। তোমরা মোক গাভি দিছেন। গাভির দুধ বেচে মুই খাওছুন। ৫-১০ টাকা জমাওছুনো।’ ডাংগীরহাট সরকারপাড়া গ্রামের ভ্যান চালক সোনা মিয়া বলেন, মোর কপাল তো মনিরুজ্জামান স্যার খুলি দিছে। আগোত দুই বেলা খাবারে পাছনু না। এ্যালা তোমার দেওয়া ভ্যান চালে প্রত্যেক দিন পাঁচ-ছয় শ টাকা কামাই করুছুং। সংসার চালার পরেও এক-দেড়’শ টাকা জমা করুছূং। তোমরা গরিব মাইনষোক খাবার দিমেন শুনি ছুটি আলছুন। মোর ভ্যান গাড়ি চাল ওবি(তুলি) সহযোগিতা করুছুং। মনটাত খুব শান্তি পাওছুন।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, মনিরুজ্জামান স্যারের তুলনা হয় না। দরিদ্র মানুষের জন্য অসম্ভব দরদ তাঁর। তিনি আমাকে পড়ার খরচ দিচ্ছে। তাঁর টাকায় আমার মা বাড়ির পাশে ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছে। আমি কথা দিচ্ছি আমিও চিকিৎসক হয় অভাবী মানুষের জন্য কাজ করব। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংগঠনের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক জেমিন শেখ বলেন, মনিরুজ্জামান স্যার আমাদের জন্য যা করছেন। তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমার মতো অনেকেরই জীবন বদলে গেছে স্যারের সভানুভবতায়। স্যারের মতো মানুষ সমাজে খুব প্রয়োজন। তবেই দেশটা বদলে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সুজন দাস বলেন, মানুষ মানুষের জন্য কথাটি মনিরুজ্জামান স্যারের কার্যক্রম দেখলেই বোঝা যায়। তিনি দরিদ্র মানুষকে ঘর করে দিয়েছে, গাভি দিয়েছে, ভ্যান দিয়েছে। শীতে শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্রও বিতরণ করেছি স্যারের সহযোগিতায়।
ওই সংগঠনের সভাপতি শিপুল ইসলাম বলেন, মহানী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন যার দ্বারা মানবজাতির কল্যাণ বৃদ্ধি পায় মানুষের মধ্যে সে-ই সর্বোত্তম। যা মনিরুজ্জামান স্যারের মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছি। উনার সঙ্গে কথা বললে মন তৃপ্তি পায়। তাঁর জনকল্যাণ মূলক কাজগুলো করতে অন্য রকম সুখ খুঁজে পাই।
ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীতে অনেক ভালো মানুষ আছে। অসহায়দের অবহেলা না করে পাশে দাড়ান তাঁরা। তাদের একজন মনিরুজ্জামান। তাঁর গড়া মানবকল্যাণ ঘর দরিদ্র মানুষের ভরসা জায়গা হয়ে উঠেছে। সংগঠনের সদস্যরা অসহায় মানুষের কল্যাণে দিনরাত ছুটে চলেছে। সংগঠনের সদস্যরা কষ্টে থাকা দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যে দৃষ্টান্ত রাখছেন তা প্রশংসনীয় ও অনুকরণীয়।